শমা নাহারকে কাছের মানুষেরা চেনেন রত্না নামে। রোমাঞ্চপ্রিয় মানুষ ছিলেন তিনি। স্বপ্ন দেখতেন এভারেস্টের চূড়ায় ওঠার। স্বপ্ন ছুঁতে শুরু করেছিলেন পর্বতারোহণ। কিন্তু তাঁর স্বপ্ন অধরা থেকে গেল। গতকাল শুক্রবার সকালে জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায় গাড়িচাপায় প্রাণ হারান তিনি। এই লেখা প্রথম আলোর শনিবারের ক্রোড়পত্র ‘ছুটির দিনে’ প্রকাশের জন্য পাঠিয়েছিলেন রেশমা নাহার। ২০১৯ সালের আগস্ট মাসেই গিয়েছিলেন ভারতের উত্তরাঞ্চলীয় লাদাখ উপত্যকার কাং ইয়াতসে ও স্টক কাংরি পর্বত অভিযানে।
স্বপ্নের শহর লেহতে যখন পৌঁছলাম, তখন সকাল সাড়ে আটটা। ছোট্ট বিমানবন্দর, দিল্লি বিমানবন্দরের তুলনায় প্রায় দশ গুণ ছোট। এ বিমানবন্দরে একটাই লাগেজ বেল্ট। আমার নীল ব্যাকপ্যাকের অপেক্ষায় দৃষ্টি আটকে আছে বেল্টের সারি সারি আসতে থাকা লাগেজের দিকে। হঠাৎ চোখ হোটেলে পৌঁছতে ১৫ মিনিট লাগল। কথা হলো, বিকেলে লেহ মার্কেটে দেখা হবে। হোটেলে পৌঁছে বিশ্রামের পর বিকেলে ছুটলাম লেহ মার্কেটের দিকে। মাত্র ১০ মিনিট হাঁটার পথ। মার্কেটে এসে আরও তিন বাংলাদেশির সঙ্গে আলাপ হলো। জানলাম, সেদিনই তাঁরা কাং ইয়াতসে-২ থেকে নেমে এসেছেন এবং বৈরী আবহাওয়ার জন্য পর্বতারোহণ হয়নি। আমি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জানার চেষ্টা করলাম ওদের অভিযান সম্পর্কে। কয়েক দিন ধরেই এখানকার আবহাওয়া বেশ খারাপ যাচ্ছে। খবর পাচ্ছিলাম স্টক কাংরি ও কাং ইয়াতসেতে প্রচুর তুষারপাত, কখনোবা বৃষ্টি। এক দিন পর জাফর ভাই এবং তাঁর বন্ধু স্টক কাংরিতে যাত্রা করলেন এবং এর এক দিন পর বৈরী আবহাওয়ার জন্য ফিরেও এলেন। আকাশের মুখভার দেখতে দেখতে আমারও মন খারাপ হতে লাগল।
ব্যর্থ অভিযান
১৬ আগস্ট সকাল। লাসমান এসে নাশতা দিয়ে গেছে। এই হোটেলটা একটি বাড়ি। দ্বিতীয় তলায় হোটেলের ব্যবস্থা। লাসমান ১২ বছরের নেপালি ছেলে। এখানে কাজ করে, বাড়িওয়ালার পাঁচ বছরের ছোট্ট মেয়ে নাঙসিম। তারই নামে নাম হোটেলের, ‘নাঙসিম গেস্টহাউস’। সেদিন দুপুর ১২টায় আমাদের কাংইয়াতসে-২–এর পথে রওনা হওয়ার কথা। তাই যাওয়ার আগে শেষবার বালিশে ঘুমানোর মোহ পেয়ে বসেছে। দেরি করে উঠব ভেবেছি। কিন্তু সাড়ে আটটা নাগাদ দরজায় আওয়াজ এল। উফ্! আর ঘুমানো হলো না। হোটেলের এই মনোরম পরিবেশ মিস করতে করতে দরজা খুললাম। রাউতেলা স্যার (ভারতের নেহরু ইনস্টিটিউট অব মাউন্টেনিয়ারিংয়ের শিক্ষক) ও তাঁর ছাত্র সৌরভ দাঁড়িয়ে আছেন হাসিমুখে। নানা জটিলতায় যখন আমি জর্জরিত, তখন নিমের পর্বতের গুরুজি রাউতেলা যেন দেবদূতের মতো হাজির হলেন আমার লাদাখ অভিযানে। আমাদের সঙ্গে যোগ হলো স্যারের আরেক শিক্ষার্থী সৌরভ। সৌরভ আমার থেকে ১০ বছরের ছোট। আমাকে লাদাখি ভাষায় ‘আরচু’ বলে ডাকে। এর অর্থ দিদি। খুব ভালো পর্বতারোহী। এই বয়সের ছেলেমেয়েরা এ দেশে কোথায় কোনো অ্যাডভেঞ্চার কোর্স করবে, তা নিয়ে মগ্ন থাকে। আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা এ ব্যাপারে যথেষ্ট ভিতু এবং খুব কমই খোঁজখবর রাখে। তা ছাড়া আমাদের বাবা-মায়েরা অতিরিক্ত ভয়ে স্কি, অ্যাডভেঞ্চার কোর্স, মাউন্টেনিয়ারিং, ট্রেকিং ইত্যাদি বিষয়ে তাদেরকে আগ্রহী করতে নারাজ। অথচ এতে এত ভয়ের কোনো ব্যাপারই নেই। উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও শিক্ষা থাকলে অসুবিধার কিছু নেই, বরং ছেলেমেয়েরা সুস্বাস্থ্যের ব্যাপারে মনোযোগী হয়।
আমরা নাশতা করে প্যাকিং করে নিলাম। স্যারের কয়েকজন স্থানীয় শিক্ষার্থী আমাদের বিদায় জানাতে এল। কোন পর্বতের কী অবস্থা, কোথায় কিসের মুখোমুখি হতে পারি, কী প্রস্তুতি আরও প্রয়োজন—এসব নিয়ে আড্ডা চলল ১২টা পর্যন্ত। জিপ এসে গেলে সামনের সিটে বসলাম প্রকৃতির অনাবিল অকৃত্রিম আভা দেখতে দেখতে দু–এক ফোঁটা শাটারবন্দীর বাসনায়। সাদা ও সোনালি পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে বয়ে চলেছে ফাঁকা রাস্তা। আর তার ওপর দিয়ে আমাদের গাড়ি। কিছুক্ষণ পরপরই দৃশ্যপট বদলে যাচ্ছে। মুগ্ধতার দহনে ছবি তুলতে ইচ্ছে করছে না। ভিডিও মুডে রেখে গাড়ির সামনের কাচের সামনে রেখে দিলাম ক্যামেরা। প্রায় এক ঘণ্টা পিচঢালা রাস্তা ছেড়ে গাড়ি যখন পাহাড়ি রাস্তা ধরল, উঁচু-নিচু পাথুরে কখনোবা ধূলিময় পথে যেতে যেতে আমাদের কলকবজা তখন প্রায় কথা বলতে শুরু করেছে। চকদো গ্রাম পর্যন্ত পৌঁছে আমরা চিউস্কিরমো ক্যাম্প সাইডের পথে ট্রেকিং শুরু করলাম। কখনো পাহাড়ের কোল ঘেঁষে মাটির রাস্তা, কখনো পাথুরে আবার কখনো পাহাড়ি নালা পার হতে হতে প্রায় দেড় ঘণ্টা পর আমরা ক্যাম্প সাইডে পৌঁছালাম।
এক্লেমেটাইজেশন ওয়াকিংয়ে যেতে স্যার তাড়া দিচ্ছিলেন। স্যারের নির্দেশে বিকেলে পাশের খাড়া পাহাড়টাতে টুক টুক করে উঠতে লাগলাম। ওপর থেকে দারুণ লাগছে চিউস্কিরমো ক্যাম্পটা। যত উপরে উঠছি, ভালো দৃশ্যপট পাচ্ছি আর ক্যামেরাবন্দী করছি। প্রায় দুই ঘণ্টা কীভাবে চলে গেল বুঝলামই না। আকাশে মেঘ জমেছে। নিচে থেকে শিটির আওয়াজ এল। বুঝলাম, নামতে বলা হচ্ছে। ওদের সঙ্গে দেখা হলো। এবার নামো। ঝটপট। হু হু করে ঠান্ডা বাতাস বইছে। দু-এক ফোঁটা বৃষ্টি এসে ছুঁয়ে দিতে লাগল। ওরে বাবা রে! প্রচণ্ড ঠান্ডা লাগছে, ক্যাম্পে ফিরেই স্লিপিং ব্যাগের ভেতর ঢুকে পড়লাম। সৌরভ চা বানাল। গরম ধোঁয়া ওঠা চা। আহ্। রাতে এখানকার ক্যানটিন থেকে খিচুড়ি কিনে তিনজন খেয়ে সেদিনের মতো ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরদিন সকাল থেকেই অল্প বৃষ্টি। সকালে ক্যানটিন থেকে নাশতা খেয়ে এবং দুপুরের খাবার সঙ্গে নিয়ে আমরা রওনা হলাম নিমালিঙের উদ্দেশে। নিমালিং যাওয়ার পথটা খুবই অস্বস্তিকর। কিছুক্ষণ পরপর পাহাড়ি নালা পার হতে হয়। গংমারুলার বেস পর্যন্ত যেতে প্রায় ২৫টি ছোট-বড় এমন নালা পার হতে হয়।
যাহোক, গংমারুলা বেস পর্যন্ত পৌঁছার পর আবহাওয়া খারাপ থেকে খারাপতর হতে শুরু করল। আকাশ দেখে গুরুজি সেখানেই তাঁবু খাটানোর সিদ্ধান্ত দিলেন। তখন দুপুর ১২টা। আমরা টেন্ট পিচ করে ভেতরে ঢুকে পড়লাম। সবাই ক্লান্ত। এরই মধ্যে তুষারপাত শুরু হলো এবং তুষারবর্ষণ ভারী থেকে ভারীতর হতে লাগল। স্যার বারবার জানতে চাইলেন, আমরা নিমালিং যেতে চাই কি না। কিন্তু আমরা সিদ্ধান্ত স্যারের ওপর ছেড়ে দিলাম। উনি যা বলবেন, আমরা তা–ই করব। শেষে সিদ্ধান্ত হলো, সেই রাতে আমরা ওখানেই থাকব এবং পরদিন আবহাওয়া ভালো হলে সোজা বেসক্যাম্প যাব।
বেশ আরামবোধ করলাম। এবার একটু বিশ্রাম নেওয়া যাক। সকাল নয়টা অবধি আমরা সিদ্ধান্ত নিতে অপেক্ষা করলাম আকাশের দিকে চেয়ে। নাহ্! একইভাবে তুষারপাত হচ্ছে। স্যার বললেন, ‘এখনই লেহ–এর পথে রওনা হতে হবে। নয়তো নামতে গিয়ে অসুবিধা আরও বাড়বে।’ তাই প্যাকআপ। আমরা ব্যাকপ্যাক, তাঁবু—সব গুছিয়ে চকদোর পথে চললাম। নামতে গিয়ে ঘটল বিপত্তি। একে তো প্রচণ্ড তুষারপাত, সঙ্গে হোয়াইট আউট হতে শুরু করেছে। অন্যদিকে ছোট নালাগুলোতে পানির প্রবাহ এত বেড়ে গেছে যে কীভাবে পার হব ভেবে দিশেহারা। উচ্চতর প্রশিক্ষণে আমরা নদী অতিক্রমের কয়েকটি পদ্ধতি শিখেছিলাম। তার একটিতেই কাজ হয়ে গেল। আমরা স্রোতে ভেসে গেলাম না, তবে কোমর পর্যন্ত ভিজলাম। যখন চকদো এলাম, দেখি আকাশ পরিষ্কার, রোদের আনাগোনা। আমরা চুপচুপে জুতা-মোজা খুলে রোদে রাখলাম। গাড়ি ডাকতে হবে, কিন্তু নেটওয়ার্ক কাজ করছে না। ওখানেই জানলাম, আজ গাড়ি বন্ধ, এই রাস্তায়। তাই গাড়ি আসবে না। স্যার বললেন, ‘এই তিন ঘণ্টা গাড়ির পথ আমাদের হেঁটে যেতে হবে।’ সুতরাং আমাদের রওনা হতে হবে। প্রায় এক ঘণ্টা হাঁটার পর একটি গাড়ি দেখতে পেলাম। দুজন কোরিয়ান গাড়িটি রিজার্ভ করেছেন। আমরা অনুরোধ করতে চালক ও কোরিয়ান ভদ্রলোক দুজন আমাদের সহযাত্রী করতে রাজি হলেন।
ব্যর্থতার পর
পরদিন স্যারের একটি বড় অভিযানের বিরাট প্রস্তুতির জন্য উত্তর কাশি ফেরার তাড়া এল। তাই পরের অভিযানে স্যার থাকতে পারবেন না জানালেন। ২৩ আগস্ট স্যারের ফ্লাইটের টিকিট হলো। স্যার চলে যাবেন, এ কথা মন মানতে চাইছিল না। তবু কিছু বললাম না। শুধু শুভকামনা জানিয়ে বললাম, ‘কোনো অসুবিধায় যেন না পড়েন।’ গেলেন ঠিকই। কিন্তু সব ব্যবস্থা করে গেলেন। এবার সহযাত্রী আমার থেকে ৮ কি ৯ বছরের ছোট স্যারের দুই শিক্ষার্থী। ওরা স্যারকে মহাভারতের গুরুর মতো ভক্তি করে। জানলাম, তাদের একই গ্রামে নিবাস। স্যার ওদেরকে ও আমাকে খুব ভালোভাবে গাইড করলেন এবং ২২ আগস্ট আমাদের জিপে রওনা করে দিলেন স্টক কাংরির উদ্দেশে। জিপে সহযাত্রী ছিলেন আমাদের হোটেলে স্কটল্যান্ডের দুজন অভিযাত্রী। বয়স ৫৫ ও ৫৮ বছর। আমরা স্টক ভিলেজে পৌঁছলাম, তখন বেলা পৌনে একটা। তাই ওখানেই লাঞ্চ সেরে ও প্যাক ডিনার সঙ্গে নিয়ে রওনা হলাম প্রথম ক্যাম্প সাইটে চাংমার উদ্দেশে। চাংমা বেশ সহজ রাস্তা। লাদাখের আবহাওয়া শুষ্ক হওয়ায় হয়তো সবুজের ঘনত্ব তেমন নেই। অক্সিজেনের পরিমাণও কম। প্রথম ক্যাম্প সাইটে পৌঁছাতে ঘণ্টা দেড়েক সময় লাগল। তাঁবু খাটিয়ে করে আমরা সেদিন সেখানেই রয়ে গেলাম। বিকেলের আকাশটা খুব পরিষ্কার। দুপাশে পাহাড় সারি সারি, মাঝখানে আমাদের ক্যাম্প। ছবির মতো সুন্দর চারপাশটা বুকে করে যতটা নিলাম, ক্যামেরায় তার এক ভাগ হয়তো ধরা পড়ল। সন্ধ্যা নেমে এল, বিউটেনে চা বানাতে বেশ লাগে। খুব দ্রুত পানি গরম হয়। চা খেতে খেতে মাঝবয়সী এক ব্রিটিশ নারীর সঙ্গে অনেকক্ষণ আড্ডা দিলাম। রাতের খাবার খেয়ে সেদিনের মতো পরদিনের লম্বা ট্রেকের কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরদিন সকাল ১০টায় রওনা হলাম বেস ক্যাম্পের উদ্দেশে। স্টক কাংরি যাওয়ার রাস্তাটা খুব অসুবিধাজনক লাগেনি। একটাই রাস্তা এবং সোজা। প্রায় দেড়টার দিকে আমরা মনোকর্মা ক্যাম্পে পৌঁছালাম। আমরা দীর্ঘ সময় ট্রেক করে ক্লান্ত। তাই কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম। মনোকর্মা থেকে বেসক্যাম্প ঘণ্টা দুয়েকের রাস্তা। বেসক্যাম্পের ঠিক আগে ৩০-৪০ কদম খাড়া চড়াই। এই চড়াইয়ের ওপরেই বেসক্যাম্প। ঘণ্টা দেড়েক লাগল আমাদের। এসে দেখি লাল-নীল-হলুদ নানা রঙের ঘুড়ির মতো প্রায় গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে আছে অসংখ্য তাঁবু। আমি প্রথম ব্যাকপ্যাক রেখেই ক্যামেরার ব্যবহার শুরু করলাম। আমাদের তাঁবু খাটানোর পর বাইরে রোদে বসে আছি। এমন সময় রান্নাঘর থেকে লুচি-সবজি হাতে একজন আমাদের সামনে রেখে গেল। কিছু বুঝলাম না। এলামই মাত্র। কাউকে চিনি না। এমন ক্ষুধার্ত আমরা, যে চোখেমুখে তখন শর্ষে ফুল দেখছি। এ সময় এমন আপ্যায়ন! কেননা আমাদের কাছে খাবার মতো স্যুপ, চা, চকলেট, ফল আর কিছু শুকনো খাবার ছিল। পরে জানলাম, একজনের শীর্ষ ছুঁয়ে আসার উদ্যাপন ছিল এটা। যাহোক, তিনজনে মহা আনন্দে উদর পূর্তি করলাম। যেহেতু আমি শারীরিক ও মানসিকভাবে ফিট ছিলাম, তাই সেদিন রাতেই আমরা সামিট পুশের সিদ্ধান্ত নিলাম। ঠিক করলাম, আমরা রাত ১০টায় রওনা হব।
কিন্তু ঘুম থেকে উঠতে দেরি হলো। রেডি হয়ে রওনা হতে হতে পৌনে ১২টা বেজে গেল প্রায়। অন্ধকারে দেখলাম, অনেকেই অনেক দূরে সামনে পৌঁছে গেছে। আকাশভরা ঝলমলে তারা। হেড টর্চের আলোগুলো দূরের ধ্রুবতারার মতো দেখাচ্ছে। আমরা ধীরে ধীরে চলতে লাগলাম। চারপাশ অন্ধকার। কিছু দেখা যাচ্ছে না। হঁাটছি তো হাঁটছিই..